Logo
Logo
×

সারাদেশ

বড় মাছ-মিষ্টির অনন্য উৎসব পোড়াদহ মেলা

Icon

বগুড়া সংবাদদাতা

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৮:০৪ পিএম

বড় মাছ-মিষ্টির অনন্য উৎসব পোড়াদহ মেলা

ছবি-সংগৃহীত

পঁচিশ কেজি ওজনের দু’টি কাতলা মাছ নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরছিলেন ব্যবসায়ী রাশেদুল ইসলাম। বাড়ির আঙিনায় পা দিতেই কলেজ পড়ুয়া শ্যালক-শ্যালিকারা খুশিতে নেচে উঠতে শুরু করে। মাছ দু’টি ছিনিয়ে নিতে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয় তার ছেলেটিও। দুই জামাই আর নাতি-নাতনিদের চমকে দিতে দেলোয়ার হোসেনও এনেছেন মাছ আকৃতির তৈরি সবচেয়ে বড় ছয় কেজি ওজনের মিষ্টি। এমন দৃশ্য বছরে একদিনই মাঘের শেষ বুধবার চোখে পড়ে বগুড়ার ঘরে ঘরে। কারন দিনটি ঐতিহাসিক পোড়াদহ মেলার।


শহর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে গাবতলীর গোলাবাড়ী সংলগ্ন পোড়াদহের মেলাটি একদিনের হলেও আশ-পাশের গ্রামে জামাই উৎসব চলে তিনদিন। মেলায় ওঠা বড় মাছ আর হরেক মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়নের পাশাপাশি উপহার হিসেবে তাদের জন্য কেনা হয় কাঠের আসবাব।

প্রবীণদের বর্ণনা মতে প্রায় দেড়শ’ বছর (অনেকের মতে ৪০০ বছর) আগে পোড়াদহ এলাকায় আশ্রয় নেওয়া এক হিন্দু সন্যাসীর স্মরণে সেখানে প্রতি বছর মেলার আয়োজন চলে আসছে। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস মতে ওই সন্যাসী যে মরা বটগাছের নিচে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন দীর্ঘ সাধনার পর সেটি আবার জীবিত হয়। এজন্য ওই স্থানটি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে আজও পূজনীয়।

মেলা উপলক্ষ্যে গতকাল বুধবার সূর্যোদয়ের পর থেকেই পোড়াদহমুখি সব সড়কে জনস্রোত নামে। অন্য বছরগুলোর মত এবারও সবার দৃষ্টি ছিল মাছপট্টির দিকে। আগে বড় মাছ বলতে বাঘাইড়-এর প্রতিদ্বন্দ্বী কোন কিছু ছিল না। কিন্তু মহাবিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় ৩ বছর আগে ২০২২ সালে বণ্য প্রাণী অপরাধ দমন ইউনিটের পক্ষ থেকে বাঘাইড় মাছটি বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে মেলায় আর বাঘাইড় মাছ চোখে পড়ে না। এবার বাজারে সবচেয়ে বড় মাছটি ছিল কাতলা। যার ওজন ছিল ২৫ কেজি। আল আমিন নামে স্থানীয় এক মৎসজীবী পাশের জেলা সিরাজগঞ্জ থেকে ৩টি কাতলা মাছ বিক্রির জন্য মেলায় এনেছেন। অপর দু’টি কাতলার ওজন যথাক্রমে ১৫ ও ১৮ কেজি। আকার ভেদে কাতলা মাছগুলো ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২টাকা কেজি দাম হাঁকা হচ্ছিল। মেলায় রুই, পাঙ্গাশ, কাল বাউশ, বোয়াল, চিতলসহ নানা জাতের কার্প মাছের আমদানি ছিল প্রচুর।


মাছের পরে ভিড় ছিল মিষ্টির দোকানগুলোতে। মেলায় এবারও মাছ আকৃতির ছয় কেজি ওজনের ‘রুই মিষ্টি’ তৈরী করেন গাবতলীর সৈয়দ আহম্মেদ কলেজ স্টেশন এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক। প্রতি কেজি ৩০০ টাকা হিসেবে বড় ওই মিষ্টির দাম ধরা হয়েছে ১ হাজার ৮০০ টাকা। 

মা-বাবার সঙ্গে মেলায় এসেছিলেন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন স্কুলের ৯ম শ্রেণির ছাত্র পরাণ হেসেন। এক সঙ্গে অনেকগুলো বড় মাছ আর বিশাল সাইজের মিষ্টি দেখে সে দারুণ খুশি। পরাণ বলে ‘এত্ত বড় মাছ আর মিষ্টি আগে কখনও দেখিনি।’ 

জয়পুরহাট থেকে আসা আব্দুল গফুর নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘গেল পাঁচ বছর ধরে আমি বগুড়ার পোড়াদহের মেলায় আসছি। বড় বড় মাছ আর মিষ্টি দেখতে খুব ভাল লাগে। তবে আগের মত জ্যন্ত মাছ আর দেখিনা। এখন ফ্রিজে রাখা মাছ আনা হয়।’ 


মেলার পার্শ্ববর্তী গোলাবাড়ি এলাকার আছিয়া সুলতানা জানান, ‘মেলা উপলক্ষ্যে জামাইদের দাওয়াত দেওয়া বাধ্যতামূলক। ঈদে দাওয়াত না করলেও জামাইরা মন খারাপ করে না কিন্তু মেলায় না ডাকলে তারা কষ্ট পায়।’ 

মেলা সংলগ্ন রাণীরপাড়া এলাকার প্রবীণ ব্যবসায়ী আব্দুল জলিল মণ্ডল জানান, বুধবার একদিনের মেলা শেষে আজ বৃহস্পতিবার মেলা প্রাঙ্গণে বসবে বউ মেলা। সেখানে চেয়ার টেবিল ও খাটসহ কাঠের নানা আসবাবপত্র কেনা-বেচা হয়।

বগুড়া লেখক চক্রের সভাপতি ইসলাম রফিক পোড়াদহের মেলাকে এ অঞ্চলের মানুষের ‘প্রাণের মেলা’ হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, আমাদের এই গ্রামীণ মেলাগুলো বাঙালি সংস্কৃতিরই একটি অংশ। পোড়াদহের মেলার জৌলুস হয়তো আগের মত নেই কিন্তু তারপরেও এই মেলাকে ঘিরেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ অঞ্চলের সব শ্রেণি পেশার মানুষ ভেদাভেদ ভুলে উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। যা ঈদ কিংবা পূজাতেও দেখা যায় না।

গাবতলী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল কালাম আজাদ বলেন, মেলাকে কেন্দ্র করে ওই এলাকায় কোন প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশের একটি টিম কাজ করছে। এছাড়া যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ কাজ করছে।

মহিষাবান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং মেলা কমিটির সভাপতি আব্দুল মজিদ মন্ডল বলেন, মেলাটি মূলত মাছের। মেলায় প্রায় ৫০০টি মাছের দোকান রয়েছে। এই দোকানগুলোতে একদিনে ৫ কোটি টাকার মতো লেনদেন হবে। 

ইশা ফাউন্ডেশনের একটি প্রকাশনা

অনুসরণ করুন