পলাতক এনায়েত, ভাইয়ের সাম্রাজ্য রক্ষায় মরিয়া মনির খন্দকার

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৫, ০৫:০৬ পিএম

ছবি-খন্দকার মনির ও এনায়েত খন্দকার (ইনসেটে)
বাংলাদেশের পরিবহন খাত দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে আলোচিত ও সমালোচিত। এই সেক্টরের অন্যতম আলোচিত নাম খন্দকার এনায়েত উল্লাহ, যিনি শুধু একজন প্রভাবশালী পরিবহন নেতা নন, বরং একজন 'সড়কের সম্রাট' হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গত ১৫ বছর ধরে তিনি দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়কে নিজের আধিপত্য বজায় রেখে প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা চাঁদা আদায়ের অভিযোগের মুখে পড়েছেন। এনায়েতের প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংযোগ, তার পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বিপুল সম্পদের বিবরণ আজ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের আওতায় এসেছে। বর্তমানে তিনি পলাতক থাকলেও তার ভাই খন্দকার মনিরের নেতৃত্বে রাজধানী পরিবহনসহ বিভিন্ন ব্যবসা এখনো সক্রিয় রয়েছে। ক্ষমতা, অর্থ এবং রাজনৈতিক প্রভাবের যোগসূত্রে গঠিত এই পরিবহন সাম্রাজ্য এখন তদন্ত ও জনআলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বাংলাদেশের পরিবহন খাত দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ম, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক প্রভাবের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। এই খাতের একচ্ছত্র প্রভাবশালী চরিত্র হিসেবে উঠে আসে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর নাম। সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক মহাসচিব, এনা ট্রান্সপোর্ট প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতার পরিচয়ে তিনি বিগত ১৫ বছর ধরে দেশের সড়ক-মহাসড়ক কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা করে চাঁদা আদায় করতেন এনায়েত উল্লাহ। শুধু ঢাকা নয়, শহরতলীর বিভিন্ন রুটেও তার নিয়ন্ত্রণ ছিল সুসংগঠিত। তার দখলে থাকা পরিবহন রুটগুলো থেকে চাঁদার নামে আদায় করা হতো বিপুল অঙ্কের অর্থ, যা নগদে নেওয়া হতো, কোনো বৈধ হিসাব ছাড়াই।
২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন এনায়েত। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি। রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থেকে নিজের প্রভাব বিস্তার করেন এবং বাগিয়ে নেন একাধিক পরিবহন কোম্পানি ও রুট।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি পলাতক হলেও তার সাম্রাজ্য এখনো ভেঙে পড়েনি। তারই বড় ভাই খন্দকার মনির এনায়েতের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়ে পরিবহন ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে তিনি ‘রাজধানী পরিবহন’-এর কর্ণধার এবং পরিবহন ব্যবসার পাশাপাশি পোলট্রি ফিড বাণিজ্যও করছেন। মিরপুর ডিওএইচএস এবং রাজধানী পরিবহনের অফিসে নিয়মিত বসতেন তিনি, তবে সম্প্রতি নারী সংক্রান্ত এক ঘটনার জেরে নিজের অবস্থান অনেকটাই সীমিত করেছেন।
জানা গেছে, গত ১৫ বছর দেশের অধিকাংশ সড়ক-মহাসড়ক তার দখলে থাকলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রয়েছেন পলাতক। আর এসবই এখন দেখভাল করছেন তারই বড় ভাই খন্দকার মনির। যিনি একসময় এনায়েতের বসুমতি পরিবহনের সর্বসর্বা ছিলেন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও বসুমতি পরিবহন হাতছাড়া হলেও এখনও বহাল তবিয়তে করছেন পরিবহণ বাণিজ্য। ‘রাজধানী পরিবহন’ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তিনি, রয়েছে পোল্ট্রি ফিড বাণিজ্য। নিয়মিত বসেন মিরপুর ডিওএইচএস-এর অফিসে এবং রাজধানী পরিবহণ অফিসে। রয়েছে ‘বড়লোকি’ সৌখিনতা। সম্প্রতি মিরপুর-১২ এ ব্লক অবস্থিত তার রাজধানী পরিবহনের অফিসে নারী ঘটিত ‘সৌখিনতা’কে ধরে ফেলেন স্থানীয়রা। যার পর থেকে মনির খন্দকার এখন সে অফিসেও আসেন অনিয়মিত। ভাইয়ের ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়।
রাজনীতির ছায়াতলে গড়ে ওঠা এই সাম্রাজ্যের পেছনে ছিলো ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রশাসনিক সুবিধা গ্রহণ এবং সড়কে গঠিত অঘোষিত 'বাহিনী'। বিভিন্ন সময় ছাত্র আন্দোলন ও গণপ্রতিরোধ রুখতে ব্যবহার হয়েছে এই নেটওয়ার্ক। অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ জুলাই আন্দোলনে মিরপুরে ছাত্রদের বিরুদ্ধে চক্রান্তের পেছনে বসুমতি পরিবহন অফিসে থাকাকালীন মনির করেছেন অর্থযোগানের নেপথ্যকারিগর। রয়েছে জুলাই আন্দোলনে বসুমতি পরিবহণ অফিসে বসে মিরপুরে ছাত্রজনতার আন্দোলন ঠেকানোর কুচক্রী কর্মকান্ডের মদদদাতার অভিযোগও। মিরপুর মডেল থানায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে ছাত্র হত্যা মামলা। তারপরও এনায়েতের নেপথ্য মদদে নিজস্ব অলিখিত বাহিনীর পাহারায় রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন খন্দকার এনায়েত। ইতিমধ্যে খন্দকার এনায়েত উল্লাহর ৪০টি ব্যাংক হিসাবে ১২৫ কোটি ৭২ লাখ ২৯ হাজার ২৮০ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যার অধিকাংশই তার ব্যক্তিগত সঞ্চয় হিসাব বলে চিহ্নিত করেছে দুদক। এছাড়া সম্পদের মধ্যে রাজধানীর মিরপুরে ৮.২৫ বিঘা জমিতে ছয়তলা বাড়ি, মিরপুরের মনিপুর পাড়ায় ৮ শতাংশ জমিতে ছয়তলা বাড়ি, ধানমন্ডির ১১ নম্বর রোডের ৬২ নম্বর বাড়ির ৪/এ নম্বরে ৩ হাজার ৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, বসুন্ধরা সিটিতে ১৫১ বর্গফুটের একটি দোকান, দক্ষিণখানে দুই জায়গায় যথাক্রমে ৭৮ শতাংশ ও ১০ শতাংশ জমি, কেরানীগঞ্জে ৪০ কাঠা ও রূপগঞ্জে ১০ কাঠা জমি। এছাড়া গাজীপুরের দনুয়ায় ৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার জমি এবং ফেনীতে ১২ শতাংশ জমি থাকার তথ্য রয়েছে দুদুকের হাতে।
দুদকের অনুসন্ধানে উঠে আসে, এসব সম্পদের উৎস হিসেবে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেখানো হলেও প্রকৃত অর্থে পরিবহন খাত থেকে আদায়কৃত চাঁদা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার থেকেই এর বড় অংশ এসেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
বর্তমানে এনায়েত পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে সরাসরি জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ দুদকের নেই। তবে তার ব্যাংক হিসাব, জমি এবং কোম্পানিগুলোর আর্থিক লেনদেন বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি সম্পদের প্রকৃত উৎস শনাক্তে কাজ করছে।
দুদকের একটি অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, এনায়েত উল্লাহর বিরুদ্ধে শিগগিরই অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হতে পারে। তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার জন্যও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
জুলাই আন্দোলনে তার ভূমিকা ও ছাত্র হত্যা মামলা বিষয়ে মনির খন্দকারের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এরকম কতো কিছুই হয় আর মামলাতো হতেই পারে।’
একসময় দেশের সড়কে যিনি ছিলেন একচ্ছত্র অধিপতি, সেই খন্দকার এনায়েত উল্লাহ এখন পলাতক। কিন্তু তার গড়ে তোলা অবৈধ সাম্রাজ্য এখনো সক্রিয়, তার ভাইয়ের নেতৃত্বে। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কতটা কার্যকরভাবে এই চক্রকে মোকাবিলা করতে পারে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।