ছবি-সংগৃহীত
অনেকে বলেন অপরাধীদের অভয়ারণ্য, নয়তোবা সন্ত্রাসের জনপদ। অনেকে বলেন অশান্তির আতুরঘর। গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও পলায়ন হলেও এখনও যেন অশান্ত বসতি রাজধানীর বৃহত্তর মোহাম্মদপুর এলাকা।
এই
জনপদের মানুষ গত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে যেমন নির্বিঘ্নে, নিরাপদে, শান্তিতে বসবাস করতে
পারেনি, তেমনি এখনও থাকেন চাপা আতঙ্ককে সঙ্গী করে। মনে ভয় নিয়ে ঘর থেকে বের হলেও বুকে
থাকে চাপা ভয়-দ্বিধা-প্রশ্ন, নিরাপদে ঘরে ফিরতে পারবো তো? আবার ঘরে ফিরলেও ঘুমানোর
আগে আরেক দুশ্চিন্তা রাতটা ভালো কাটবে তো? সব মিলিয়ে এই হচ্ছে বৃহত্তর মোহাম্মদপুর
এলাকার বাসিন্দাদের হাল অবস্থা। বিশেষ করে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পুলিশ কিছুটা নিষ্ক্রিয়
থাকার সুযোগে এ এলাকায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীরা, যারা কিশোর গ্যাং
নামে পরিচিত।
৫
আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর গত কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত সংবাদে
এমনই তথ্য উঠে এসেছে।
গত ৫
আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, শুধু
মোহাম্মদপুরেই খুন হয়েছে ১০ জন। এসব খুনের নেপথ্যে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার, মাদক কারবার
নিয়ন্ত্রণ ও বাজার দখল। প্রকাশ্যে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মহড়া, গোলাগুলি এই
এলাকায় যেন নিয়মিত ঘটনা।
আরও
জানা যায়, মোহাম্মদপুর এলাকায় অপরাধের বেশিরভাগই ঘটাচ্ছে কিশোর বয়সি উঠতি অপরাধীরা।
স্থানীয় রাজনৈতিক ‘বড় ভাই’ এবং বিভিন্ন ওয়ার্ডের কতিপয় সাবেক আর বর্তমান
কাউন্সিলরদের ছত্রছায়া বা নিয়ন্ত্রণে থেকেই ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একসময় ভাসমান ও
নিম্ন আয়ের কিংবা বস্তিতে থাকা পরিবারের সন্তানরা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত থাকলেও এখন উচ্চ
মধ্যবিত্ত, এমনকি ধনীদের সন্তানরাও এই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য হচ্ছে। তাদের পোশাক, চুলের
কাটিং, দামি মোটরবাইকে চলাফেরা সবকিছুই অস্বাভাবিক। প্রায় সবার হাতেই থাকে লেটেস্ট
মডেলের মোবাইল ফোন, পরনে দামি পোশাক।
গণমাধ্যমে
প্রচারিত বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, গত ২৯ জুলাই ৩৩ নং ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতা
কামাল হোসেনকে কাটাসুরে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর নবোদয় হাউজিং
এলাকায় স্থানীয় কবজি কাটা গ্রুপের মূলহোতা আনোয়ার, রংপুইরা আকাশ, রাফাত, তুষার ও আহমেদের
নেতৃত্বে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ফাইটার বিল্লাল গাজী নামে এক যুবককে। ৪ সেপ্টেম্বর জেনেভা
ক্যাম্পে সনু নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর শাহাদাত নামে এক
যুবককে গ্রিন ভিউ হাউজিং এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০ সেপ্টেম্বর রায়েরবাজারে নাসির
ও মুন্না নামে দুই যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর চাঁদ উদ্যানে ৩৩ নম্বর
ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি মান্নান হোসেন ও একই ওয়ার্ডের লাউতলা ইউনিটের নেতা রিয়াজ ধারালো
অস্ত্রের আঘাতে আহত হন। ২ অক্টোবর রাতে স্বপ্নধারা হাউজিংয়ের ১ নম্বর রোড থেকে শুরু
করে প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিভিন্ন গলির মুখে ব্যারিকেড দিয়ে অস্ত্রের মুখে
ছিনতাই করে একদল সশস্ত্র কিশোর। তারা অন্তত ১৫-২০ জন পথচারীর টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন
ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ১২ অক্টোবর গভীর রাতে সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরে সংঘবদ্ধ ডাকাত
তিনরাস্তা মোড় সংলগ্ন ‘আবু কোম্পানির বিল্ডিং’ নামে পরিচিত পাঁচতলা ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি বাসা থেকে সাড়ে ৭৫
লাখ টাকা ও ৬০ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে। ১৬ অক্টোবর রাতে জেনেভা ক্যাম্পে গুলিবিদ্ধ
হয়ে শানেমাজ ওরফে শাহনেওয়াজ ওরফে কাল্লু নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। গত দুই মাসে সানু,
শাহেন শাহ ও সাগরসহ ৫ জন নিহত হয়েছেন এই ক্যাম্পে। ১৭ অক্টোবর ভোরে বসিলা চল্লিশ ফুট
এলাকায় এক সিএনজি অটোরিকশা চালককে কুপিয়ে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। ১৯ অক্টোবর বসিলায়
ছিনতাইকারীরা তিন ব্যক্তির কাছ থেকে অস্ত্রের মুখে দুটি মোবাইল ফোন ও ৯ হাজার টাকা
ছিনিয়ে নেয়। ২০ অক্টোবর মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেড এলাকায় দুটি মোটরসাইকেলে করে ছয়
ছিনতাইকারী প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে গাড়ি ভাঙচুর করে এবং একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের
১১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা ও ১৭ হাজার টাকার চেক ছিনিয়ে নেয়। ২২ অক্টোবর ভোরে মোহাম্মদিয়া
হাউজিংয়ের ৬ নম্বর রোডে রামদা-চাপাতি নিয়ে মুরগিবোঝাই মিনিট্রাকের পথরোধ করে ৬-৭ জন
তরুণ। তারা ২৪ হাজার টাকা ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। ট্রাক থেকে মুরগি নিয়ে যাওয়ার সময়
বাধা দেওয়ায় মুরগির মালিক কাশেমকে কুপিয়ে জখম করা হয়। গত ১৫ নভেম্বর নুরজাহান রোডে
৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক
দোলন সহ বেশ কয়েকজন সাবেক এমপি বিপ্লবের বাসায় জোর করে প্রবেশের চেষ্টা করে। এই সময়ে
লোকজনের চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এলে তারা ধারালো অস্ত্র নিয়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে
থাকে। এ সময় মোহাম্মদ আলী নামে একজনকে কুপিয়ে আহত করে ৩৩ নাম্বার ওয়ার্ড যুবদলের
সাবেক আহবায়ক দোলনসহ বেশ কয়েকজন। পরে তারা মোটরসাইকেলে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় করা
মামলায় ১৭ নভেম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাবেক আহ্বায়ক দোলনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়া
এজহারভুক্ত কাইয়ুম হোসেন, মো শাহিন, নাসির ও সাব্বির পলাতক রয়েছে। কথিত আছে মোহাম্মদপুর
থানার সাবেক যুবদলের সভাপতি জাহিদ মোড়লের একনিষ্ঠ সহযোগী এই দোলন।
ঢাকা
মহানগর গোয়েন্দা বা ডিবি পুলিশের নথি অনুযায়ী মোহাম্মদপুর এলাকার তিন রাস্তার মোড়,
চাঁদ উদ্যান, লাউতলা, নবীনগর হাউজিং, বসিলা চল্লিশ ফিট, কাঁটাসুর, তুরাগ হাউজিং, আক্কাস
নগর, ঢাকা উদ্যান নদীর পাড়, চন্দ্রিমা হাউজিং, নবীনগর হাউজিং, বসিলা হাক্কার পাড়, আদাবর,
শামলী হাউজিং, নবোদয় হাউজিং, তাজমহল রোড, নূরজাহান রোড, শ্যামলী রিং রোড, রায়েরবাজার,
হুমায়ুন রোড ও বাবর রোডের আশেপাশে জেনেভা ক্যাম্প এলাকা, টাউন হল ও আসাদ অ্যাভিনিউয়ের
আশপাশ, আজম রোড, ইকবাল রোডে কিশোর গ্যাং জাতীয় অপরাধীদের তৎপরতা বেশি। ছোটবড় মিলিয়ে
এই এলাকায় রয়েছে ৩০টি কিশোর গ্যাং। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২২টি হচ্ছেÑ ঠেলার নাম
বাবাজি, ডায়মন্ড গ্রুপ, সালাম পার্টি, আসসালামু আলাইকুম পার্টি, দে ধাক্কা গ্রুপ, ব্রেকফাস্ট
পার্টি, টক্কর ল, পাটালি গ্রুপ, লাড়া দে, লেভেল হাই, দেখে ল-চিনে ল, ল ঠেলা গ্রুপ,
কোপাইয়া দে, ভাইপার, তুফান, টিকটক, ডিসকো বয়েজ, বিগ বস, নাইন স্টার, এসকে হৃদয় গ্রুপ,
রনি গ্রুপ ও বিচ্ছু বাহিনী।
স্থানীয়
সূত্রে জানা যায়, সাবেক আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি হাজী মকবুলের ছত্রছায়াতেই মোহাম্মদপুরে
গড়ে ওঠে অপরাধরাজ্য। পরে বিভিন্ন সময়ে বৃহত্তর মোহাম্মদপুর এলাকার সন্ত্রাস আর অপরাধের
গডফাদার হয়ে ওঠেন জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবু সাইদ বেপারি (মারা গেছেন), সলু (কারাগারে),
সাদেক খান (কারাগারে), সলুর ভাই জয়নাল হাজী (মারা গেছেন), রতন (মারা গেছেন), মতিন
(মারা গেছেন), সেন্টু, পাগলা মিজান, চিনু মিয়া, লালমাটিয়ায় আনোয়ার হোসেন মোড়ল, জাকির
হোসেন রোডে মিন্টু, আদাবরের নবী, হারিস, আনিস, কাশেম, হাসু, ইকবাল, তুহিন, রাজু (মারা
গেছেন) প্রমুখ। সলু, সাদেক খান, সেন্টু, আসিফ আহমেদ ও তারেকুজ্জামান রাজীব, চিনু মিয়া,
পাগলা মিজান, হাসু, ইকবাল, তুহীন, নবী, হারিস, কাসেম এরা বর্তমানে গা ঢাকা দিয়ে দেশে
বা দেশের বাইরে থাকলেও বৃহত্তর মোহাম্মদপুর এলাকার অপরাধ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণের চাবি
এখনও তাদের হাতেই।
মোহাম্মদপুর এলাকার কয়েকজন সচেতন বাসিন্দা বলেন, বর্তমানে এলাকায় পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছেন। কিছুদিন আগেও যৌথবাহিনীর অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই অভিযানে মোহাম্মদপুরের শীর্ষ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী আদম বেপারী সেলিম, দুর্ধর্ষ রুহুল গ্যাংয়ের শীর্ষ সন্ত্রাসী ইব্রাহিম এবং সাগরকে আটক করা হয়। এছাড়াও, জেনেভা ক্যাম্পে মাদক চক্রের দুইজন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী, ১০ জন ছিনতাইকারী এবং কিশোর গ্যাংয়ের সাতজন দুষ্কৃতকারীকে আটক করা হয়। এই অভিযানে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে মোট ২২ জন অপরাধী গ্রেপ্তার হয়। এছাড়া কয়েকদিন আগেই রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার আলোচিত সন্ত্রাসী কাইল্লা সুমন, যুবদল নেতা দোলনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সার্বিকভাবে এখন পরিস্থিতি আগের চাইতে অনেক স্বাভাবিক এবং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে।