নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়াই চলছিল ভবন নির্মাণের কাজ, প্রাণ গেল ৩ শ্রমিকের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০৫:১৩ পিএম
প্রতিকী ছবি
সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ঘরে রেখে সকালে কাজে যান নির্মাণশ্রমিক অন্তর। কথা ছিল দুপুরে বাসায় ফিরে স্ত্রীর সঙ্গে খাবার খাবেন। চোখে অনাগত সন্তানের স্বপ্ন আর দুপুরের রান্না নিয়ে ব্যস্ততা বেড়ে যায় স্ত্রী শ্রাবন্তীর। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! দুপুরে বাসায় ফেরেননি অন্তর। ফিরেছেন সন্ধ্যায়, তবে কফিনবন্দি হয়ে। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকার মায়াকানন ৭ নম্বর জামে মসজিদের পাশে একটি নির্মাণাধীন ভবনের ১০ তলা থেকে নিচে পড়ে প্রাণ হারান তিনি। একই দুর্ঘটনায় মারা যান তার আরও দুই সহযোগী মফিজুল ইসলাম ও আলতাফুর রহমান।
জানা যায়, ভবনটিতে নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়াই নির্মাণকাজ চলছিল। ফলে
ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার সময় অসাবধানতাবশত ১০ তলা থেকে নিচে পড়ে যান ওই তিন শ্রমিক। ঘটনাস্থলেই
মারা যান দুইজন। অপরজনের মৃত্যু হয় হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায়।
এদিকে ঘটনার পর থেকেই ভবনের মালিক আমিনুল হক ও ঠিকাদার মো. ফারুক
পলাতক। এ ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
নিহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, এ ঘটনায় বাড়ির মালিক ও ঠিকাদার মিলে প্রত্যেক
পরিবারকে ৩ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। এ ছাড়া মরদেহ দাফনের জন্য
দেওয়া হবে ৪০ হাজার টাকা করে। তবে ইমারত শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) নেতারা বলছেন,
একটি জীবনের বিনিময়ে এ ক্ষতিপূরণ খুবই সামান্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার
(ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, ভবনমালিকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হবে।
নিহতদের বিষয়ে জানা গেছে, জামালপুর সদর উপজেলার চরপাড়া গ্রামের মো.
রাব্বানীর ছেলে নিহত মফিজুল ইসলাম। পরিবার নিয়ে থাকতেন মায়াকাননে। তিন ভাইয়ের মধ্যে
তিনি ছিলেন বড়। নিহত আলতাফুরের বাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার গুনেরবাড়ী গ্রামে। তার বাবার
নাম গোলাপ শেখ। একই এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি। এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি।
আর নিহত অন্তর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা তারাটিয়া চরপাড়া গ্রামের আকরাম হোসেনের ছেলে।
তিনিও থাকতেন ওই এলাকায়।
সবুজবাগ থানার এসআই রবীন্দ্রনাথ সরকার বলেন, শুক্রবার সকাল ১০টার
দিকে সবুজবাগের মায়াকানন জামিয়াতুল মসজিদের পশ্চিম পাশে নির্মাণাধীন ভবনের ১০ তলায়
১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করছিলেন। পাইলিংয়ের কাজ করার সময় মাচা ভেঙ্গে নিচে পড়ে যান ওই
তিন শ্রমিক। তাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় মুগদা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে।
সেখানে আলতাফুর ও অন্তরকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসা চলছিল
মফিজুলের। উন্নত চিকিৎসার জন্য দুপুরের দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া
হয়। ২টার দিকে সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। মরদেহ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
মফিজুলের মামা মিজানুর রহমান প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, রাজমিস্ত্রির
সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন মফিজুল। সকাল ১০টার দিকে ভবনের ১০ তলার বাইরের পাশে মাচায়
উঠে দেয়াল প্লাস্টারের কাজ করছিলেন মফিজুল, আলতাফুর ও অন্তর। তখন মাচার রশি ছিঁড়ে তারা
তিনজনই নিচে পড়ে যান।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভবনটিতে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায়
ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছিলেন শ্রমিকেরা। ভবনের ওপর থেকে হঠাৎ করেই বাঁশের মাচা ভেঙ্গে ঘটে
এমন দুর্ঘটনা। এলাকাবাসী জানান, অনিয়মের অভিযোগে ভবনটি রাজউক একবার ভেঙ্গে দেয়।
অন্তরের বাবা আকরাম বলেন, গ্রামের অভাব-অনটনের সংসার ছেড়ে পরিবার
নিয়ে তারা সবাই ঢাকায় এসেছিলেন ভাগ্য বদলের আশা নিয়ে। নিজে একটি বাড়িতে দারোয়ানের কাজ
করেন। স্ত্রী কাজ করেন অন্যের বাসাবাড়িতে। আর ছেলে অন্তর রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে
মায়াকাননের ওই বাড়িতে কাজ করতেন।
তিনি জানান, দুই বছর আগে বিয়ে করেন অন্তর। এরপর থেকে মা-বাবা, ভাই
ও স্ত্রীকে নিয়ে আহমেদবাগের একটি ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন। ঘরে নতুন অতিথি আসা উপলক্ষে
বাবা-মা থেকে আলাদা হয়ে সম্প্রতি নতুন একটি ঘর ভাড়া নেন অন্তর।
সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগল প্রায় অন্তরের মা
আনোয়ারা। আর স্বামীর মৃত্যুর খবরে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন স্ত্রী শ্রাবন্তী। স্বামীর শোকে
বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন তিনি।
বাবা আকরাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছোট্ট
সংসার। অভাব-অনটনের সংসার। সব ভালোই চলছিল। কিন্তু মুহূর্তেই কী হয়ে গেল… আমার বউ মা
অন্তঃসত্ত্বা। তাকে কী বুঝ দিব। আমার নাতি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই আল্লাহ ওর বাবাকে
নিয়ে গেল।’
ওই ঠিকাদারের অধীনেই কাজ করেন নিহত আলতাফুর রহমানের চাচাতো ভাই খোকন।
তিনি বলেন, ‘আমরা পাশাপাশি ভাড়া বাসায় থাকি। সকালে আলতাফ মায়াকাননের সাইটে কাজে যায়,
আমারা অন্য সাইটে কাজে যাই। সকাল ১০টা সাড়ে ১০টার দিকে শুনতে পাই মায়াকাননের সাইটে
দুর্ঘটনা ঘটছে। তখনও ভাইয়ের খবর পাইনি। পরে মেডিকেলে গিয়ে লাশ শনাক্ত করি।’
তিনি জানান, আলতাফের স্ত্রী বিউটি ঢাকায় অন্যের বাসাবাড়িতে ছুটা কাজ
করেন। এই দম্পতির দুই শিশুসন্তান গ্রামে দাদা-দাদির সঙ্গে থাকে।
খোকন বলেন, রাতে স্থানীয় ক্লাবে একটি বৈঠক হয়েছে। সেখানে বাড়ির মালিক
ও ঠিকাদার হতাহতদের প্রতি পরিবারকে ৩ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ও মরদেহ দাফনের জন্য নগদ
৪০ হাজার টাকা দিয়েছেন। তবে ৩ লাখ টাকা পরে দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন,
‘কিন্তু টাকা দিয়ে কী হবে ভাইকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।’
এ ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলতে নারাজ ইমারত শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের সাধারণ
সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকবলেন, ‘ঘটনার পর আমাদের নেতৃবৃন্দ ঘটনাস্থল
পরিদর্শন করেছে। রাতে তারা থানায় গিয়েছে। নির্মাণশ্রমিকদের দুর্ঘটনায় মৃত্যু নয়, এটাকে
আমরা অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড বলতে চাই। এক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্টদের আমরা অনেকটা
দোষ দিই। কারণ শ্রমিকদের কর্মস্থলে নিরাপত্তাবেষ্টনী আছে কি না, তাদের স্বাস্থ্যকর
পরিবেশ আছে কি না, এগুলো দেখভাল করার দায়িত্ব শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা
ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের। কিন্তু তারা কোনো দায়িত্ব পালন করছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘এদের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে মালিক ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এ ছাড়া কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের, রাজউক, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি সম্মিলিতভাবে সেফটি কমিটি করতে হবে।’
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘একটি জীবনের বিনিময়ে ৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ খুবই সামান্য।’